ছোট শিশুর বমি তার অভিভাবকের জন্য বিশেষ চিন্তার কারণ। নবজাতক এবং ছোট শিশুর অন্যতম কমন একটি সমস্যাও এটি। চলুন জেনে নেই কোনটি বমি, কোনটি বমি নয়; এবং বমির কারণ সমূহ ও করণীয়।
দুধ তোলা বা স্পিট আপ সত্যিকার অর্থে বমি নয়। এর প্রধান কারণ অতিরিক্ত খাওয়ানো এবং রিফ্লাক্স। বমি এবং দুধ তোলার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দুধ তোলার ক্ষেত্রে সাধারণত দুধ বের হয় যেটা গাল বেয়ে পরে এবং বাচ্চার অন্য কোন কষ্ট থাকে না। অন্যদিকে বমি সাধারণত দই এর মতন হয়, সজোরে বের হয় এবং বাচ্চার কষ্ট হচ্ছে বোঝা যায়। দুধ তোলার প্রধান কারণ ২ টিঃ
ওভার ফিডিংঃ নবজাতকের কান্না মানেই অনেক মা মনে করেন বাচ্চার ক্ষুধা লেগেছে। এই ধারণা থেকে বার বার বাচ্চাকে খাওয়াতে থাকেন। ফলে বাচ্চার ছোট্ট পাকস্থলি পূর্ণ হয়ে উলটা পথে দুধ বের হয়ে আসে।
গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স (GERD): মানুষের পাকস্থিলির উপড়ের দিকে যেখানে ইসোফেগাস মিলিত হয়েছে সেখানে একটা রিং এর মত রয়েছে যেটাকে মেডিক্যাল টার্মে স্ফিংটার বলা হয়। এটা একটা এক দিকে প্রবেশ পথ। খাবার খাওয়ার পর এটা প্রসারিত হয় এবং খাবার ইসোফেগাস থেকে পাকস্থলিতে যায়। এরপর এই স্ফিংটার সংকুচিত হয়ে যায় এবং খাবার ব্যাক ফ্লো করতে পারে না। কিন্তু নবজাতক এবং ছোট্ট শিশুদের এই রিং সুগঠিত থাকে না বিধায় খাবার উলটা পথে ব্যাক ফ্লো করতে পারে এবং দুধ তোলার মত ঘটনা ঘটতে পারে। এই স্ফিংটার সাধারণত ৫-৬ মাস নাগাদ সুগঠিত হয়ে যায় এবং এই বয়সের পর দুধ তোলার সমস্যাটিও অনেকাংশে সামাধান হয়ে যায়।
পেটে গ্যাসঃ নবজাতক বাচ্চাদের বমির অন্যতম প্রধান একটা কারণ পেটে গ্যাস। নবজাতক বাচ্চারা বুকের দুধ খাওয়ার সময় এবং ফিডার খাওয়ার সময় প্রচুর বাতাস খেয়ে ফেলে। এই গ্যাস ছোট্ট পাকস্থলিতে অযাচিত চাপ দেয়। ফলে পাকস্থলির দুধ দূর্বল স্ফিংটারকে চাপ দিয়ে বমি হিসাবে বের হয়ে যেতে পারে। শুধু নবজাতক নয় বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও গ্যাসের সমস্যা বমির একটা কারণ।
ঠান্ডা লাগা, সর্দি, কাশিঃ ঠান্ডা লাগা, সর্দি এবং কাশি বমির আরেকটি প্রধান কারণ। সর্দির সময় ফুসফুসে মিউকাস বেড়ে যায় এবং সেটা প্রধান শ্বাসতন্ত্রে অস্বস্থি করে এবং বমি হিসাবে প্রকাশ পায়। অনেক সময় কাশতে কাশতেও বমি হয়ে যেতে পারে।
অতিরিক্ত নড়াচড়া বা লাফালাফিঃ অনেক সময় আমরা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে অতিরিক্ত নড়াচড়া করি এবং দোলাতে থাকি। বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও অনেক সময় বাচ্চারা অতিরিক্ত লাফালাফির কারনে বমি হতে পারে।
কৃমিঃ আমাদের দেশে কৃমির সংক্রমণ খুব খুব কমন একটি বিষয়। কৃমি শুধু বাচ্চাদের নয়, এডাল্টেও খুব কমন সমস্যা। কিন্তু কৃমির সংক্রমণ এর উপসর্গ খুব একটা প্রকাশ পায়না এবং হালকা উপসর্গ দেখা দিলেও সবাই এটা মানতে রাজী হয়না। কৃমির সংক্রমণের সবথেকে বড় লক্ষণ বমি বমি ভাব হওয়া বা বমি হওয়া।
প্রস্রাবে ইনফেকশনঃ ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রস্রাবে ইনফেকশন খুব ভাল ভাবে উপসর্গ সহ প্রকাশ নাও পেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই শুধু ক্ষুধা মন্দা, অরুচি, বুকের দুধ খাওয়া ছেড়ে দেওয়া এবং বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া সমস্যা নিয়ে প্রস্রাবে ইনফেকশন প্রকাশ পেতে পারে। হতে পারে প্রস্রাবে ইনফেকশন হয়েছে কিন্তু প্রস্রাবে কোন একটি সমস্যাও দেখা দেয়নি।
কোষ্ঠকাঠিন্যঃ কোষ্ঠকাঠিন্য এমন একটি সমস্যা যেটা বমি উপসর্গ নিয়ে প্রকাশ পেতে পারে। সাথে পায়খানা কষা হওয়ার সমস্যাও থাকবে। এরকম সমস্যায় মুখের রুচি কমে যাওয়া, বমি ভাব হওয়া বা বমি হওয়ার মত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ডায়ারিয়া বা ফুড পয়জনিংঃ ডায়ারিয়া বা ফুড পয়জনিং একটা একিউট সমস্যা যেটা হুট করেই দেখা দিবে। ডায়ারিয়ায় অনেক গুলো ধরণ রয়েছে। এর মধ্যে ভাইরাল ডায়ারিয়া সাধারণত শুরুই হয় বমি দিয়ে। ভাইরাল ডায়ারিয়া এবং ফুড পয়জনিং এ বমির সমস্যা প্রধান হিসাবে থাকে তবে অন্যান্য সকল ডায়ারিয়ায়ও পাতলা পায়খানার সাথে বমি থাকতে পারে।
গ্যাসট্রাইটিসঃ গ্যাসট্রাইটিস হলো পাকস্থলির বিশেষ ধরনের ইনফেকশন যেটা প্রধানত হ্যালিকোব্যাকটার পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়া দিয়ে হয়। এই সমস্যাটি মূলত এডাল্টে হয়ে থাকলেও গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় সকল শিশুই ৬-৮ বছরের মধ্যে এই ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে কয়েক দফায় আক্রান্ত হয়ে যায়। সুতরাং এটা শিশু এবং বাচ্চা সকলের জাতীয় সমস্যা হিসাবে প্রতীয়মান হয়।
ঔষধের ইফেক্টঃ বেশ অনেক এন্টিবায়টিকই বমির ভাব করে। কিছু কিছু এন্টিবায়েটিক সহ অন্য কিছু ঔষধও বমির কারণ হতে পারে।
অন্যান্য ইনফেকশনঃ শরীরে বেশ কিছু ইনফেকশন যেমন নিউমোনিয়া, মেনিঞ্জাইটিস (ব্রেনে ইনফেকশন), রক্তে ইনফেকশন (সেপসিস), কানের ইনফেকশন, শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন, গলায় ইনফেকশন বমির কারন হতে পারে।
এলার্জি জনিত বমিঃ বাচ্চা এলার্জিক হলে নির্দিষ্ট এলার্জিক খাবার খাওয়ালে বমি হতে পারে।
অন্যান্যঃ তীব্র মাত্রার জ্বর, হরমনাল কারণ, তীব্র মাথা ব্যাথা থেকে বমি হতে পারে।
সার্জিক্যাল সমস্যা গুলোঃ
হাইপারট্রফিক পাইলোরিক স্টেনোসিসঃ ছোট নবজাতক বাচ্চাদের এক ধরণের সমস্যা রয়েছে যেটায় পাকস্থলির শেষের দিকে কিছুটা মাংসপেশী ফুলে যায় এবং পাকস্থলির বর্হিগমন পথকে বন্ধ করে দেয়। এই সমস্যাটি ১ মাস নাগাদ শুরু হয় এবং বাচ্চা দুধ খাওয়ানোর পর পর দই এর মত বমি করে, যেটা বেশ স্পিডের সাথে দূরে গিয়ে পরে এবং বাচ্চা এর কিছুক্ষণ পরই ক্ষুধায় কান্না করে। এধরণের বাচ্চা সাধারনত বার বার বমির কারনে খুবই রুগ্ন হয়।
অন্ত্রনালী আটকে যাওয়াঃ অনেক গুলো ভিন্ন ভিন্ন কারণে অন্ত্রনালীতে পায়খানা আটকে যেতে পারে। যেমনঃ মিকোনিয়াম আইলিয়াস, হার্শপ্রাংগস ডিজিজ, জন্মগত এট্রেশিয়া, ম্যালরোটেশন, ইন্টাসাসেপশন, কোন পাশের টিউমার, ইন্টেসটাইনাল অবসট্রাকশন ইত্যাদি। এধরনের বমি গুলো হলুদ/সবুজ রঙ এর হয়। জন্মের পর পর বমি শুরু হলে ক্ষুদ্রান্তে এট্রেশিয়া (ক্ষুদ্রান্ত পুরোপুরি গঠন না হওয়া) সমস্যার কথা ভাবতে হবে।
এপেন্ডিসাইটিসঃ আরেকটি খুব কম সমস্যা যেটা আমরা পাই সেটা হলো এপেন্ডিসাইটিস। এই সমস্যাটি সাধারণত বড় বাচ্চাদের বেশি হয়ে থাকে। বমির সাথে পেট ব্যাথা এবং জ্বর থাকে সাধারণত।
বমির সমস্যা হলে কারন বের করে সমাধান করতে হবে।
স্পিট আপ বা দুধ তোলার সমস্যা থাকলে বাচ্চাকে অতিরিক্ত খাওয়ানো পরিহার করতে হবে। অনেকে বলে থাকে এধরণের বমি ভালো! কিন্তু আসলে কোন বমিই বাচ্চার জন্য ভালো নয়। নিয়মিত বমি হলে বাচ্চা খাবারের পুষ্টিগণ পাবে না। ফলে বাচ্চার বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে।
রিফ্লাক্স থেকে মুক্তি পেতে বাচ্চাকে খাওয়ানোর পর না শুইয়ে কোলে খাড়া রাখতে হবে ১৫-৩০ মিনিট। এটা একেক বাচ্চার জন্য একেক রকম সময় লাগতে পারে। বাচ্চাকে খাড়া রাখার ফাকে ফাকে ঢেকুর তোলানোর চেষ্টা করতে হবে। বাচ্চার পেট ঘাড়ের উপড় নিয়ে ঢেকুর তোলানো যায়, এছাড়া পায়ের উপড় বাচ্চার পেট রেখেও ঢেকুর তোলানোর চেষ্টা করতে পারেন।
বাচ্চাকে খাওয়ানোর পর অতিরিক্ত নড়াচড়া পরিহার করতে হবে।
নবজাতক বা ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে গ্যাসের সমস্যা একটি খুবই কমন সমস্যা। এই সমস্যায় সাধারণত ফ্লাকল (সেমেথিকন) ড্রপ ৩ বেলা ভালো কাজে দেয়। ৩ মাসের বাচ্চার ক্ষেত্রে ৫-৬ ফোটা ৩ বেলা, ৬ মাসের বাচ্চার ক্ষেত্রে ১০ ফোটা করে ৩ বেলা দেয়া যাবে।
বাচ্চার ঠান্ডা লাগলে, সর্দি বা কাশি হলে সুচিকিৎসা করতে হবে।
বাচ্চার বয়স ১ বছর হয়ে গেলে অবশ্যই বাচ্চাকে কৃমির ঔষধ দিয়ে দিবেন এবং কোন সমস্যা না থাকলেও নিয়ম করে ৬ মাস পর পর বাচ্চাকে কৃমির ঔষধ দিতে ভুলবেন না। বাচ্চার যদি কৃমির কোন উপসর্গ থাকে তবে ৬ মাসের জন্য অপেক্ষা না করে যেকোন গ্যাপে বাচ্চাকে কৃমির ঔষধ দিতে হবে। কৃমির ঔষধের ক্ষেত্রে ৭-১৪ দিনের মধ্যে অবশ্যই ডোজ রিপিট করবেন এবং পুরো পরিবার একসাথে কৃমির ঔষধ খেলে ভালো।
ডায়ারিয়া বা ফুড পয়জনিং এর ক্ষেত্রে চিকিৎসা করলে বমিও ভালো হয়ে যাবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে কারণ বের করে কোষ্ঠকাঠিন্য চিকিৎসা করতে হবে।
কোন কারন ছাড়া বাচ্চার বমি হচ্ছে এরকম মনে হলে শরীরে কোন লুকায়িত ইনফেকশন আছে কিনা খুজতে হবে। যেমন কোন ফোড়া, কানের ইনফেকশন, দাতের ইনফেকশন, প্রস্রাবে ইনফেকশন ইত্যাদি।
বমির কিছু সার্জিক্যাল কারণ রয়েছে যেসব উপড়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণত হলুদ সবুজ বমি এবং বমির সাথে ২-৩ দিনের পায়খানা না হওয়ার হিস্ট্রি সার্জিক্যাল কারণ এর সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়। তবে বার বার বমি হওয়ার কারনেও কিছুটা হলুদ বমি হতে পারে।
বমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব দুশ্চিন্তার কারন নয় এবং ৯০% ক্ষেত্রে সাধারন কিছু সমস্যায় বেশি বমি পাওয়া যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বমি চিন্তার কারণও বটে। আপনার বাচ্চার বমি আপনার কাছে সাধারন সমস্যা মনে না হলে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ শিশু ডাক্তারের সাহায্য এবং পরামর্শ নিবেন। আশাকরি আর্টিকেলটি আপনার জ্ঞান বাড়াবে এবং আপনার ছোট্ট শিশুর পরিচর্যায় আপনাকে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে।
বমি হলে বাচ্চাকে কাত করে শোয়াতে হবে যেন বমি শ্বাসতন্ত্রে চলে গিয়ে জটিলতা তৈরী না হয়। বমির সমস্যা হলে এর কারণ বের করে চিকিৎসা করতে হয়। বমি চলমান থাকলে প্রাথমিক ভাবে বমি বন্ধ করার জন্য সিরাপ ইমিস্টেট খাওয়াবেন খাওয়ার ৩০ মিনিট পূর্বে। ওজন অনুসারে ডোজঃ (খাওয়ার ৩০ মিনিট পূর্বে)
৫ কেজি - ১.২ মিলি করে ৩ বেলা।
১০ কেজি - হাফ চামচ (২.৫ মিলি) করে ৩ বেলা।
২০ কেজি - ১ চামচ (৫ মিলি) করে ৩ বেলা।
MBBS, MS (Pediatric Surgery)
SCHP (Paediatrics) Australia, CCD
Child Specialist & Pediatric Surgeon
চেম্বারঃ
আল-মারকাজুল ইসলামী হাসপাতাল
২১/১৭, বাবর রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
সিরিয়ালের জন্য কল করুনঃ 01755515556 (দুপুর ৩ টায়)
সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল
২৩/৬, রুপায়ন শেলফোর্ড, লেভেল ৮, শ্যামলী। (শিশু মেলার বিপরীতে)
সিরিয়ালের জন্য কল করুনঃ 09642400300
অনলাইন কনসালটেশনঃ m.me/cdc.dhaka.bd